বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম: যে নামে শুরু হয় মুমিনের প্রতিটি কাজ
ইসলামে প্রতিটি কাজের সূচনা হয় মহান আল্লাহ তা'আলার নামে। এই সূচনা করার সর্বোত্তম, সবচেয়ে সুন্দর ও শক্তিশালী বাক্য হলো "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম"। এটি শুধু কয়েকটি শব্দের সমষ্টি নয়, বরং এটি একজন মুমিনের বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং তাঁর অশেষ করুণা লাভের প্রবেশদ্বার।
এই বিশদ বিবরণে আমরা জানব, কেন এই বাক্যটি এত মহিমান্বিত এবং কীভাবে এর সঠিক প্রয়োগ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে বরকতময় করে তুলতে পারে।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" এর অর্থ ও গভীর তাৎপর্য
আরবি:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
বাংলা উচ্চারণ: "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম"
বাংলা অর্থ: "পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।"
এই আয়াতে আল্লাহর তিনটি প্রধান নাম ও গুণের উল্লেখ রয়েছে:
আল্লাহ (اللَّهِ): এটি মহান সৃষ্টিকর্তার সত্তাবাচক (ذاتي) নাম। এই নামে অন্য কাউকে ডাকা যায় না। এটি সকল গুণের আধার।
আর-রাহমান (الرَّحْمَٰنِ): অর্থ "পরম করুণাময়"। আল্লাহর এই রহমত বা করুণা দুনিয়াতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য। তাঁর এই গুণের কারণেই সমগ্র সৃষ্টি জগৎ তাঁর নিয়ামত ভোগ করছে।
আর-রাহিম (الرَّحِيمِ): অর্থ "অসীম দয়ালু"। আল্লাহর এই গুণটি বিশেষভাবে মুমিনদের জন্য। পরকালে তিনি বিশ্বাসীদের প্রতি পরম দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করবেন।
সুতরাং, যখন কোনো মুমিন "বিসমিল্লাহ" বলেন, তখন তিনি শুধু একটি কাজ শুরু করেন না, বরং এই সাক্ষ্য দেন যে—আমার এই কাজের ক্ষমতা আমার নয়, আমি সেই মহান আল্লাহর নামে ও সাহায্যে শুরু করছি, যিনি দুনিয়া ও আখিরাতে সবকিছুর উপর করুণাময় ও দয়ালু।
কুরআনের আলোকে 'বিসমিল্লাহ'
"বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" পবিত্র কুরআনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি সূরা আত-তাওবা ছাড়া কুরআনের বাকি ১১৩টি সূরার শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, যা এর অসাধারণ গুরুত্ব বহন করে।
১. নবীদের সুন্নত: হযরত সুলাইমান (আ.) যখন সাবার রানী বিলকিসকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন, তখন সেই চিঠির সূচনা হয়েছিল 'বিসমিল্লাহ' দিয়ে।
إِنَّهُ مِنْ سُلَيْمَانَ وَإِنَّهُ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
বাংলা উচ্চারণ: "ইন্নাহু মিন সুলাইমা-না ওয়া ইন্নাহু বিসমিল্লাহির রাহমা-নির রাহীম।"
বাংলা অর্থ: "নিশ্চয়ই এই চিঠি সুলাইমানের পক্ষ থেকে এবং তা পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু) হয়েছে।" (সূরা আন-নামল, ২৭:৩০)
২. আল্লাহর নামে নিরাপত্তা ও আশ্রয়: হযরত নূহ (আ.) মহাপ্লাবনের সময় তাঁর অনুসারীদের আল্লাহর নামে কিশতিতে আরোহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
وَقَالَ ارْكَبُوا فِيهَا بِسْمِ اللَّهِ مَجْرَاهَا وَمُرْسَاهَا
বাংলা উচ্চারণ: "ওয়া ক্বা-লারকাবূ ফীহা বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়া মুরসা-হা।"
বাংলা অর্থ: "এবং তিনি (নূহ) বললেন, 'তোমরা এতে আরোহণ কর। এর গতি ও স্থিতি আল্লাহরই নামে'।" (সূরা হুদ, ১১:৪১)
৩. হালাল-হারামের মানদণ্ড: খাবারের মতো একটি মৌলিক বিষয়েও আল্লাহর নাম নেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ
বাংলা উচ্চারণ: "ওয়ালা তা'কুলূ মিম্মা লাম ইয়ুযকারিসমুল্লা-হি 'আলাইহি ওয়া ইন্নাহু লাফিসক্ব।"
বাংলা অর্থ: "আর তোমরা তা থেকে খেয়ো না, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয়ই তা হলো ফিসক (পাপকাজ)।" (সূরা আল-আন'আম, ৬:১২১)
হাদিসের আলোকে 'বিসমিল্লাহ'র তাৎপর্য ও ফজিলত
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জীবনে ও বাণীতে 'বিসমিল্লাহ'র গুরুত্ব ফুটে উঠেছে বারবার।
১. কাজের পূর্ণতা ও বরকতের চাবিকাঠি:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: "كُلُّ أَمْرٍ ذِي بَالٍ لاَ يُبْدَأُ فِيهِ بِـ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ فَهُوَ أَقْطَعُ". (মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ)
বাংলা উচ্চারণ: "আন আবী হুরায়রাতা (রাঃ) ক্বালা: ক্বালা রাসূলুল্লাহি (ﷺ): 'কুল্লু আমরিন যী বা-লিন লা ইয়ুবদাউ ফীহি বি-বিসমিল্লাহির রাহমা-নির রাহীম ফাহুয়া আক্বতা'।"
বাংলা অর্থ: আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: "প্রত্যেক এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' দ্বারা শুরু করা হয়নি, তা অসম্পূর্ণ (বা বরকতহীন) থেকে যায়।"
এর অর্থ, যেকোনো বৈধ কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ পাঠ করলে আল্লাহ সে কাজে বরকত দেন এবং তা সহজ ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার তাওফিক দান করেন।
২. শয়তানের প্রভাব থেকে শক্তিশালী ঢাল: 'বিসমিল্লাহ' পাঠ শয়তানকে বিতাড়িত করে এবং তার ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয়।
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: "إِذَا دَخَلَ الرَّجُلُ بَيْتَهُ فَذَكَرَ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ وَعِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ الشَّيْطَانُ: لاَ مَبِيتَ لَكُمْ وَلاَ عَشَاءَ". (সহিহ মুসলিম)
বাংলা উচ্চারণ: "আন জা-বিরিবনি 'আবদিল্লা-হি, আন্নাহু সামি'আন নাবিয়্যা (ﷺ) ইয়াক্বূলু: 'ইযা দাখালার রাজুলু বাইতাহু ফাযাকারাল্লা-হা 'ইনদা দুখূলিহি ওয়া 'ইনদা ত্বা'আ-মিহি, ক্বা-লাশ শাইত্বা-নু: লা মাবীতা লাকুম ওয়ালা 'আশা-ء'।"
বাংলা অর্থ: জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছেন: "যখন কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশ করার সময় এবং খাবার খাওয়ার সময় আল্লাহকে স্মরণ করে (বিসমিল্লাহ বলে), তখন শয়তান (তার সঙ্গীদেরকে) বলে, 'আজ রাতে তোমাদের এখানে থাকা ও খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই'।"
৩. খাবার শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' বলা (ভুলে গেলে করণীয়):
عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: "إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ فَلْيَذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ تَعَالَى، فَإِنْ نَسِيَ أَنْ يَذْكُرَ اسْمَ اللَّهِ تَعَالَى فِي أَوَّلِهِ فَلْيَقُلْ بِسْمِ اللَّهِ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ". (সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিযী)
বাংলা উচ্চারণ: "আন 'আয়িশাতা (রাঃ) আন্না রাসূলাল্লাহি (ﷺ) ক্বালা: 'ইযা আকালা আহাদুকুম ফালইয়াযকুরিসমাল্লা-হি তা'আ-লা, ফাইন নাসিয়া আন ইয়াযকুরিসমাল্লা-হি তা'আ-লা ফী আওয়ালিহি ফালইয়াক্বুল: বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আ-খিরাহু'।"
বাংলা অর্থ: আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: "তোমাদের কেউ যখন খাবার খায়, সে যেন আল্লাহ তা'আলার নাম স্মরণ করে (বিসমিল্লাহ বলে)। যদি সে শুরুতে বলতে ভুলে যায়, তবে সে যেন বলে, 'বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আ-খিরাহু' (এর শুরু এবং শেষের জন্য আল্লাহর নামে)।"
দৈনন্দিন জীবনে 'বিসমিল্লাহ'র প্রয়োগ
ইবাদত: কুরআন তিলাওয়াত, অযু এবং সালাতের শুরুতে।
কাজকর্ম: পড়ালেখা, অফিস বা ব্যবসার কাজ শুরুর আগে।
দৈনন্দিন জীবন: খাওয়া, পান করা, পোশাক পরা, ঘরে প্রবেশ বা ঘর থেকে বের হওয়া, যানবাহনে ওঠা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে।
উপসংহার
"বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" কেবল একটি প্রথা নয়, এটি আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও নির্ভরতার ঘোষণা। এটি আমাদের শেখায় যে, আমাদের সকল শক্তি ও সফলতা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। যখন আমরা প্রতিটি কাজ আল্লাহর নামে শুরু করি, তখন সেই কাজে শুধু বরকতই আসে না, বরং আমাদের সাধারণ পার্থিব কাজগুলোও ইবাদতে পরিণত হয়।
আসুন, আমরা এই মহিমান্বিত বাক্যটিকে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করি এবং আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত লাভে নিজেদের জীবনকে ধন্য করি।
0 মন্তব্যসমূহ